রমজান ও রোজা – রোজার গুরুত্ব ও ফযীলত
রোজার গুরুত্ব
আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন:
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিল।”
(সূরা: আল-বাকারা-১২৩)
![]() |
রমজান ও রোজা |
আরও এরশাদ করেন:
“রমজান এমন মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে যার সব কিছুই হেদায়াতে পরিপূর্ণ। আর এমন সুন্দর শিক্ষার সমন্বয় যা সরল পথ প্রদর্শনকারী এবং সত্য-মিথ্যাকে পার্থক্যকারী। ফলে যে ব্যক্তি এই মাস পায় তার কর্তব্য এসব দিনে রোজা রাখা।” (সূরা: আর-বাকারা-১৮৫)
হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশান করেছেন:
যিনি আমার জীবনের মালিক তার শপথ! রোজাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশক আম্বরের সুঘ্রাণ অপেক্ষা অধিক সুগন্ধীময়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- রোজাদার ব্যক্তি কেবল আমার সন্তুষ্টির জন্য কামনা-বাসনা এবং পানাহার করা হতে বিরত থাকে। কাজেই যখন সে শুধু আমার উদ্দেশ্যেই রোজা রাখে তখন আমি নিজেই তাকে তার রোজার প্রতিদান দিব। আমি অন্যান্য পুণ্যের প্রতিদান দশ হতে সাতগুণ দিয়ে থাকি। কিন্তু রোজা তার ব্যতিক্রম (অসীম)। কারণ, রোজা শুধু আমার জন্যই রাখা হয়। ফলে রোজার প্রতিদান আমার ইচ্ছামতো আমি দেব।
রোজার এই বিশেষত্বের কারণ এই যে সমস্ত ফরজ ইবাদত বন্দেগির মধ্যে কেবল রোজাই এমন ইবাদত যা সম্পূর্ণ গোপনীয় বিষয়। বাহ্য কোন কিছুর সাথেই তার সম্পর্ক নেই। আল্লাহ ছাড়া অন্য আর কারও কোন অংশ নেই। রোজা এমন এক ইবাদত যদি কারও মনে আল্লাহর কোন ভয় না থাকে তাহলে সে অতি সহজে পানাহার করে লোককে দেখাতে পারে যে সে রোজাদার এবং আল্লাহ ভক্ত।
রোজার মধ্যে চুরি করা আল্লাহ ছাড়া আর কারও সাধ্য নেই যে তা করতে পারবে। তাই হজরত জোনায়েদ (র) বলেছেন: রোজা তরীকতের অর্ধাংশ। কারণ রোজার মধ্যে লোক দেখানো কিছু নেই। আন্তরিকতা ছাড়া কেউ রোজা রাখতে পারে না।
রোজার শর্ত
প্রতি রোজার জন্য নিয়ত করা শর্ত। ফরজ রোজার নিয়ত ফজরের পূর্বে করা আবশ্যক। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) বলতেন: যে ব্যক্তি ফজরের আগে নিয়ত না করে তার রোজা হয় না। হজরত আয়েশা ও হজরত হাফসা (রা)-ও এই কথা বলতেন। নফল রোজার নিয়ত সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা) বলেন:
“একদিন মহানবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট তাশরীফ এনে বললেন: আয়েশা! খাবার কিছু আছে কি? হজরত আয়েশা বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! কিছুই তো নেই। তখন তিনি বললেন, তবে আজ আমি রোজা রাখলাম।” (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)
এ থেকে আলেমগণ বলেছেন, নফল রোজার নিয়ত দিনেও করা যায়। অবশ্য রোজার নিয়ত করা ব্যতীত যদি কেউ সারাদিন পানাহার করা হতে বিরত থাকে, তাহলে তাতে রোজা হবে না।
দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, পেটকে পানাহার হতে, চোখকে খারাপ কিছু দেখা হতে, কানকে খারাপ কিছু শোনা হতে এবং পুরো দেহকে শরীয়ত বিরোধী কোন কাজ করা হতে বিরত রাখা।
মহানবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন:
যখন তুমি রোজা রাখবে তখন তোমার সকল অঙ্গ-প্রতঙ্গদকে আল্লাহর অপছন্দনীয় কর্ম এবং তার নিষিদ্ধ কর্ম হতে বিরত রাখবে।
আরও এরশাদ করেছেন:
“বহু রোজাদারের অনাহারে থাকা ছাড়া আর কিছু লাভই হয় না।”
আমি ভেবে অবাক হই যে, কোন কোন লোক নফল রোজা রেখে শুকিয়ে কাঠে পরিণত হয় অথচ ফরজের কোন তোয়াক্কা করে না। অথচ আল্লাহর অপছন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা ফরজ। নফল রোজা রাখা মাত্র সুন্নত। আমরা আল্লাহ নিকট এ জাতীয় কাজ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।
রোজার হাকিকত
রোজার হাকিকত ইমসাক। অর্থাৎ নফসের কামনাকে সংযত রাখা এবং নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা। তাই হজরত জোনায়েদ (র) বলেছেন, রোজা তরিকতের অর্ধাংশ।
হজরত আলী হাজবিরী বলেন, আমি একবার মহানবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে স্বপ্নে দেখে আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ আমাকে কিছু উপদেশ দিন।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন তোমার পঞ্চইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখ।” চোখ, কান, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক এই পঞ্চইন্দ্রিয় যেমন সৎ কাজে তদ্রূপ পাপের কাজের জন্য সমান উপযোগী। এই পাঁচটি ইন্দ্রিয় দ্বারাই লোকে আল্লাহর ফরমাবরদারী করে; আবার নাফরমানীও করে। কাজেই পঞ্চইন্দ্রিয়কে স্ববশে রাখার জন্য রোজাই একমাত্র সামান।
হুজুর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও বুযুর্গদের নীতি
রোজার এই প্রতিক্রিয়ার দরুনই মহানবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার অনুসরণ করার জন্য সাহাবায়ে কেরাম অধিকহারে রোজা রাখতেন। মহানবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান ছাড়াও একাধিক্রমে রোজা রাখতেন। সাহাবায়ে কেরাম তার অনুসরণ করতে গেলে মহানবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করলেন:
“তোমরা সওমে বিসাল (কোন কিছু পানাহার না করে একাধিক্রমে রোজা রাখা) থেকে বিরত থাক। সাহাবাগণ আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তো করেন। মহানবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমাদের মতো নই। আমার ঘটনা তোমাদের থেকে আলাদা। তোমাদের প্রভুর নিকট আমি রাত অতিবাহিত করি। তিনি আমাকে পানাহার করান।” (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)
এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে একটি সম্প্রদায় বলে, এই নিষেধ মাকরূহে তাহরিমী জাতীয় নিষেধ নয়। বরং হাকিকত বর্ণনা জাতীয়। তাথাপি এঁরা বলেন, এই রোজা রাখার মধ্যে যদি এক ফোঁটা পানিও পান করে তবে সওমে বিসাল হবে না।
হজরত সহল ইবনে আবদুল্লাহ তশতরি সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি প্রতি মাসের পনের তারিখে একবার মাত্র আহার করতেন। রমজান মাসের প্রথম হতে ঈদ পর্যন্ত সর্বপ্রকার পানাহার হতে বিরত থাকতেন। এটা সত্ত্বেও তিনি প্রতি রাতে চারশত রাকআত নফল নামায আদায় করতেন। আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ব্যতীত এটা কারও পক্ষে সম্ভবপর নয়।
হজরত ইবনে আদহাম সারা রমজান মাসে কোন কিছু পানাহার করতেন না। এই রমজান মাস ছিল গরমের মাস। তিনি সারাদিন গম কেটে যা মজুরি পেতেন তা গরিবদের দান করে দিতেন। লোকে তাঁর পেছনে লেগে থাকল যে তিনি কিছু পানাহার করেন কিনা? কিন্তু কেউই তাঁর পানাহার করার প্রমাণ পান নি এবং কেউই তাঁকে রাতে ঘুমাতে দেখেন নি।
হজরত শায়খ আবু নসর তাউসুফ ফোকারা রমজান মাসে বাগদাদে হাজির হন এবং তাকে শোনেযিয়া মসজিদের একটি কোঠায় থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। তারাবি পড়ানোর দায়িত্বও তাঁকে দেওয়া হয়। তারাবিতে তিনি পাঁচবার কুরআন খতম করেন। প্রতি রাতে তাঁর খাবার হিসেবে একটি করে রুটি দেওয়া হতো।
ঈদের দিন তিনি ঈদের নামায পড়তে গেলে খাদেম তাঁর কামরায় প্রবেশ করে দেখেন ত্রিশখানি রুটি তেমনই পড়ে রয়েছে।
আলী ইবনে বাকা (র) বলেন: হাফছ মাসীসী (র) রমজানের পনের রোজা অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কিছু খেতেন না।
গ্রন্থকারে বলেন: আমি বহু বুযুর্গকে চাঁদের তের, চৌদ্দ এবং পনের তারিখে রোজা রাখতে দেখেছি। আবার অনেককে একদিন পর একদিন রোজা রাখতে দেখেছি। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই রোজাকে ভালো রোজা নামে অভিহিত করেছেন।
আমি এমন বুযুর্গও দেখেছি তারা রোজা রাখতেন। অবশ্য কেউ খাবার এনে সম্মুখে হাজির করলে কোন কথা না বলে আহার করতেন। অর্থাৎ তারা চাইতেন না যে তিনি রোজা রাখেন একথা অন্য লোকে জানুক।
এটা সুন্নত অনুযায়ী আমল। হজরত আয়েশা ও হাফসা (রা) বলেন, মহানবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গৃহে তাশরীফ আনলে তাঁরা বললেন, আমরা আপনার জন্য হাইস (ঘি), খেজুর এবং ছাতু মিশ্রিত এক প্রকার খাবার, রান্না করে রেখেছি। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমি তো আজ রোজা রাখার নিয়ত করেছিলাম। আচ্ছা নিয়ে এসো, এর পরিবর্তে অন্য আর একদিন রোজা রাখবো।
কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে, এটা নফল রোজার ক্ষেত্রে। শরীয়তসিদ্ধ কোন কারণ ব্যতীত ফরজ রোজা ছাড়া যায় না। ছাড়লে কাফফারা ওয়াজিব হয়।
পৃথিবীতে দু’শ্রেণির লোক আছে। এক শ্রেণির লোক বাতেন এবং পরকালের সম্পদ আহরণে নিয়োজিত থাকে যেন সর্বোতভাবে আল্লাহরই হয়ে যায়। অপর শ্রেণির লোক আজীবন শরীয়ত পালনে লিপ্ত থাকে। তাই প্রথম শ্রেণির লোক এই নিয়তে পানাহার করে থাকেন যে খাদ্যদ্রব্য দ্বারা দেহে শক্তি হবে এবং উক্ত শক্তি আল্লাহর ইবাদত বন্দেগিতে ব্যয় করবে। আর দ্বিতীয় শ্রেণির লোক পার্থিব সাচ্ছন্দ উপভোগ করার উদ্দেশ্যে পানাহার করে। সুতরাং উভয় শ্রেণির লোকের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য বিদ্যমান।
হজরত হাজবিরী (র) তাঁর সমসাময়িক লোকদের লক্ষ করে বলেন:
“পূর্ববর্তী বুযুর্গগণ এজন্য খাবার গ্রহণ করতেন যেন তারা জীবিত থাকেন। কিন্তু তোমাদের পানাহারের উদ্দেশ্য শুধুই পানাহার করা।”