মুসলিম উম্মাহ’র ১৪’শ বছরের তারাবীহ’র ইতিহাস।
এ শিরোনামের অধীনে প্রত্যেক শতাব্দী থেকে এমন দু’একজন বিশিষ্ট আলেমের নাম কিতাবের উদ্বৃতিসহ পেশ করা হচ্ছে যারা বিশ রাকাত তারাবীহর প্রতি সমর্থন দিয়েছেন বা তাঁর সময়ে বিশ রাকাত তারাবীহ’র আমল জারী থাকার স্বীকৃতি দিয়েছেন।
দ্বিতীয় শতাব্দীঃ ইমাম শাফেঈ- মৃত্যু:১৫০ হিজরী । (মুখতাছারুল মুঝানী, অধ্যায়: নফল ও তারাবীহর নামায)
তৃতীয় শতাব্দী : ইমাম তিরমিযী-মৃত্যু:২৭৯ হিজরী। (তিরমিযীঃ ৮০৪ নং হাদীসের আলোচনায়)
চতুর্থ শতাব্দী: ইমাম আবু মুহাম্মাদ কায়রওয়ানী- মৃত্যু-৩৮৬ হিজরী । (আর রিসালা, অধ্যায়ঃ রোজা)
পঞ্চম শতাব্দী: আল্লামা ইবনু আব্দিল বার-মৃত্যু:৪৬৩ হিজরী । (আত তামহীদ, আল
ইসতিয্কার, অধ্যায়: কিয়ামু রমাযান)
ষষ্ট শতাব্দী : আল্লামা আবু বকর কাসানী-মৃত্যু:৫৮ ৭ হিজরী । (বাদাইউস সানায়ে-পরিচ্ছেদ: তারাবীহর নামাযের পরিমাণ) এ শতাব্দীর আরও একজন ইমাম ইবনে রুশদ মালেকী-মৃত্যু:৫৯৫
হিজরী। (বিদায়াতুল মুজতাহিদ, অধ্যয়: কিয়ামু রমাযান)
সপ্তম শতাব্দী : আল্লামা ইবনে কুদামা হাম্মলী-মাতৃ:৬২০ হিজরী। (আল্ মুগনী, পরিচ্ছেদ: ১০৯৫) এ শতাব্দীর আরও একজন ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম নববী-মৃত্যু ৬৭৬ হিজরী। (শরহুল মুহাজ্জাব, অধ্যায়: কিয়ামু রমাযান)
অষ্টম শতাব্দী : শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া-মৃত্যুঃ ৭২৮ হিজরী। (মাজমূউল ফাতাওয়া,অধ্যায়: সিফাতুস সলাত)
নবম শতাব্দী : বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আল্লামা ওয়লিউদ্দীন ইরাকী-মৃত্যু:৮২৬ হিজরী (তরহুত তাছরীব ফি শরহিত তাকরীব, তারাবীহর রাকাত শিরোনামে)
দশম শতাব্দী : ইমাম আল্লামা শিহাবুদ্দীন কসতলানী-মৃত্যু ৯২৩ হিজরী। ইরশাদুস সারী ফি শরহিল বুখারী, অধ্যায়ঃ কিয়ামুল্লাইলের
ফযীলত) এ শতাব্দীর আরও একজন ফকীহ আল্লামা ইবনে নুজাইম মৃত্যু-৯৭০ হিজরী। (বাহরুর রায়েক, অধ্যয়ঃ তারাবীহর নামায)
একাদশ শতাব্দী : আল্লামা শামসুদ্দীন রমালী-মৃত্যু ১০০৪ হিজরী। (নিহায়াতুল মুহতাব, অধ্যায়ঃ জামাতে আদায়যোগ্য নফল)
দ্বাদশ শতাব্দীঃ আল্লামা শিহাবুদ্দীন আযহারী-মৃত্যঃ ১১২৬ হিজরী। (আল ফাওয়াকিহুদ দাওয়ানী, অধ্যায়: রমাযানে তারাবীহ’র নামাযের বিধান)
ত্রয়োদশ শতাব্দী : আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী-মৃত:১২৫২ হিজরী। রদ্দুল মুহতার, আলোচনা: তারাবীহ’র নামায)
চতুর্দশ শতাব্দী : যুগশ্রেষ্ট় মুহাদ্দিস ও ফকীহ আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী-মৃত্যু:১৩৫৩ হিজরী। (আরফুশ শাযী, অধ্যায়: কিয়ামু শাহরি রমাযান)
তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণঃ
তাহাজ্জুদের নামায দ্বারা অনেকে তারাবীহর দলীল দেয়ার চেষ্টা করে থাকেন কিন্তু আসলে দুই নামাযের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। রাসুলুল্লাহ স.-এর তাহাজ্জুদ নামাযের চিত্র কেমন ছিলো সে ব্যাপারে কয়েকটি হাদীস পেশ করা হচ্ছে যা থেকে বুঝা যাবে যে, তারাবীহ আর তাহাজ্জুদ এক নয়।
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ স.(বিতিরসহ) ৭ রাকাত, ৯ রাকাত এবং ১১ রাকাত নামায পারতেন (বুখারী-১০৭৩) হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ স. রমাযান ও রমযানের বাইরে ১১ রাকাতের বেশী পড়তেন না। তিনি প্রথমে ৪ রাকাত তারপরে ৪ রাকাত তারপরে ৩ রাকাত পড়তেন। (বুখারী শরীফ-১০৮১) হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ স. দুই দুই রাকাত করে ১২ রাকাত পড়েছেন তারপরে বিতির পড়েছেন। (বুখারী -১৮৩) এ হাদীসগুলো দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, রসূলুল্লাহ স.-এর রাতের নামাযের রাকাত সংখ্যা সবসময় একই রকম থাকতো না। বরং ৪ থেকে ১২ পর্যন্ত উঠা-নামা করতো। তাহলে এ হাদীস দ্বারা ৮ রাকাত তারাবীহর স্থির সিদ্ধান্ত কিভাবে হতে পারে? ৮ রাকাত তারাবীহ’র দাবীদারদের সবচেয়ে মজবুত হাদীস বুখারী শরীফে বর্ণিত ১০৮১ নং হাদীস যা উপরে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ স. রমাযান ও রমযানের বাইরে ১১ রাকাতের বেশি পড়তেন না। এ হাদীসের শেষাংশে উল্লেখ রয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ স. প্রথমে পড়তেন ৪ রাকাত তারপরে ৪ রাকাত তারপর ৩ রাকাত। অথচ ৮ রাকাত তারাবীহ’র দাবীদারগণ পরে থাকে দুই দুই রাকাত করে। তাহলে দলীল আর অমলের মিল খুঁজে পাওয়া যায় কি? রসূলুল্লাহ স. তারাবীহ’র নামায তিন দিন জামাতের সাথে পড়ে এ কথা বলে জামাতে পড়া ত্যাগ করলেন যে, আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে তোমাদের উপর তারাবীহ ফরয হয়ে যেতে পারে। (বুখারী-১০৬২)
তরাবীহ আর তাহাজ্জুদ যদি একই নামায হয় তাহলে তাহাজ্জুদ তো ইসলামের শুরু যুগ আবশ্যক ছিলো।(ছুরা মুঝ্ঝাম্মিল, আয়াত-২) অতঃপর আল্লাহ তাআলা সেটাকে রহিত করেছেন। (ছূরা মুঝ্ঝাম্মিল, আয়াত-২০) ফলে তাহাজ্জুদ নামায আর আবশ্যক থাকেনি। এ আয়াতের তাফসীরে হযরত ইবনে আব্বাস রা. হযরত ইকরাম, মুজাহিদ, হাসান বসরী, এবং কতাদা রহ. সহ অনেক সাহাবা ও তাবেঈন ও মতই পাষোণ করেছেন। (তাফসীরে ইবনে আব্বাস, তাফসীরে মুজাহিদ, তাফসীরে ইবনে কাসীর) ছূরা মুঝ্ঝাম্মিল ২০ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা যে সকল কারণ উল্লেখ করে উল্লেখ করে এটাকে রহিত করলেন সে কারণগুলো উম্মতের মধ্যে দিন দিন আরও বৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও রসূলল্লাহ স. কর্তৃক এটাকে পুনরায় ফরয হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ হতে পারে না। সুতরাং কোনক্রমেই তারাবীহ আর তাহাজ্জুদ এক নামায নয়। অতএব, তাহাজ্জুদ নামাযের রাকাত সংখ্যা দিয়ে তারাবীহর দলীল দেয়া চৌদ্দশ বছরে উম্মত মেনে নেয়নি এখনো নেবে না।
এর বিপরীতে একটি হাদিসে হযরত উপার রা. কর্তৃক কায়েমকৃত জামাতে তারাবীহ’র নামায় ৮ রাকাত ছিলো (বিতরসহ ১১ রাকাত) বলেও উল্লেখ রয়েছে। অনেকে সেটাকে রসূলুল্লাহ স.-এর আমলের অনুরূপ বলে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করলেও হাদীসটির বর্ণনাকারী ইমাম মালেক রহ. নিজে সেটাকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করেননি। উপরন্ত উক্ত প্রধান্যদানের কারণের উপর মৌলিকভাবে আরও দুটি আপত্তি রয়েছে।
এক. উক্ত বর্ণনার সনদের রাবীগণ যদিও নির্ভরযোগ্য। কিন্তু হযরত উমরের তারাবীর রাকাত সংখ্যা ২০ বলে যে সকল হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছ তার সনদ সহীহ হওয়ার পাশাপাশি সংখ্যায়ও অনেক বেশি। সাথে সাথে একদল তাবিঈ থেকেও উক্ত আমলের অনুকরণের প্রমাণ রয়েছে। উপরন্তু রয়েছে উম্মতের চৌদ্দশ বছরের আমল। এ সব কিছুর বিপরীতে একটি সনদকে প্রাধান্য দেয়া হাদীসের নীতিমালার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
দুই. আবার ৮ রাকাত তারাবীহ’র ওই আমলটি রসূলুল্লাহ স.-এর আমলের অনুরূপ কথাটিও ঠিক নয়। কারণ, রসূলুল্লাহ স.-এর নামাযের অনুরূপ বলে বুঝানো হচ্ছে হযরতের রাতের নামায অর্থাৎ কিয়ামুল লাইল। আর তার রাতের নামাযের রাকাত সংখ্যা (বিতিরসহ) এগারো রাকাত নির্ধারিত নয়। বরং হযরত আয়েশা রা. থেকে বুখারী শরীফ ১০৭৩ নম্বর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে ৭ রাকাত, ৯ রাকত এবং ১১ রাকাত। হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বুখারী শরীফ ১৮৩ নম্বর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে বিতির ব্যতীত ১২ রাকাত। এর সাথে তিন রাকাত বিতির যুক্ত হলে মোট হবে ১৫ রাকাত। হযরত আয়েশা রা.-এর বর্ণনা থেকে আরও জানা যায় যে, রমাযান এবং রমযানের বাইরে রসূলুল্লাহ স.-এর আমল একই রকম ছিলো। কিন্তু শুধু সহীহ হাদীসহ নয়, বরং বুখারীর হাদীসে যেখানে রাতের নামাযের রাকাত সংখ্যা সংক্রান্ত চারটি বর্ণনা রয়েছে। তার মধ্যে থেকে শুধু ৮ রাকাতের বর্ণনাকে রসূলাল্লাহ স.-এর তারাবীহ’র নামাযের আমল বলে প্রচার করা বুখারী শরীফে বর্ণিত অন্যান্য সহীহ হীসকে অজ্ঞাত কারণে আড়াল করা বা অস্বীকার করা হবে। উপরোক্ত হাদীসগুলোসহ আরও যে সকল সহীহ হাদীসের কথা বলে উম্মতকে ৮ রাকাত তারাবীহর দিকে ডাকা হচ্ছে উক্ত সহীহ হাদীসগুলো উম্মতের মুহাদ্দিস, ফকীহ এবং গবেষকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তাঁরা বারবার ওই সকল সনদের প্রতি লক্ষ্য করে বেশ কিছু সুন্দর মন্তব্য করেছেন। তন্মধ্যে ইমাম বাইহাকী রহ.এর মন্তব্যটি অধিকতর প্রণিধানযোগ্য। ইমাম বাইহাকী রহ. বলেন, উভয় প্রকার হাদীসের মধ্যে এভাবে সমম্বয় সাধন সম্ভব যে, তাঁরা প্রথমে ১১ রাকাত পড়েছেন। পরে সেটা ছেড়ে দিয়ে ২০ রাকাতের আমল গ্রহণ করেছেন। আর বিতির পড়েছেন ৩ রাকাত। উম্মতের মধ্যে আজ পর্যন্ত বহাল রয়েছে।
সাহাবায়ে কেরামের সেই সোনালী যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কোন যুগে কেউই ৮ রাকাত তারাবীহ পড়ার উদাহরণ সৃষ্টি করেনি। চৌদ্দশ বছর পর্যন্ত চলে আসা ২০ রাকাত তারাবীহর অবিচ্ছিন্ন ধারায় ফাটল ধরিয়ে ৮ রাকাত তারাবীহ’র ধারণা প্রচার করে সর্বপ্রথম পুস্তিকা রচনা করেন শায়খ নাসীব রেফয়ী। তৎকালীন আরব বিশ্বের উলামায়ে কিরাম তার উক্ত নবসৃষ্ট মতাদর্শ কলমযুদ্ধের মাধ্যমে জোরালোভাবে খণ্ডনও করেছেন। কিন্তু অত্যন্ত অপ্রিয় সত্য হলো শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী তখনকার হক্কানী-রব্বানী উলামায়ে কেরামের অনুসরণ না করে উম্মতের মধ্যে ফাটল সৃষ্টিকারী শায়খ নসীব রেফয়ীর পক্ষ সমর্থন করেছেন। এমনকি ১৩৭৭ হিজরী সনে ‘তাসদীদুল ইসাবাহ’ নামে একটি বই রচনা করে শায়খ রেফায়ীর মতাদর্শকে প্রাধান্য দেয়ার অপচেষ্টা করেছেন। মারকাযুদ্দাওয়া আল ইসলামিয়া ঢাকার শিক্ষাসচিব উপ মহাদেশের অন্যতম মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক দামাত বারাকাতুহুম এ ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, বইটি তার ভ্রান্তি-বিচ্যুতি এবং মুসলিম উম্মাহ ও ইমামগণের প্রতি বিদ্রোহ-বিদ্বেষের খোলা দলীল। সাথে সাথে ইলমে উসূলে হাদীসা ও যরাহ- তাদীল বিষয়ে তার অপরিপক্কতার জ্বলন্ত প্রমাণ। এ ছাড়া ইলমে উসূলে ফিকহের মধ্যে তার দৈন্যদশাও বইটিতে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে; যা সত্যিই মর্মান্তিক।