বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে হাদীস-বিচার | The science of Hadith in Islam.
হদীসের কোন সিদ্ধান্তকে বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে বিচার করার চেষ্টা করা হয় নাই। কারণ, সকল বৈজ্ঞানিক মতবাদই যে অভ্রান্ত তাহা নহে; গ্রীক বিজ্ঞানের বহু মতবাদ আজ ভ্রান্ত বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে।
![]() |
বিজ্ঞান ও হাদীস |
খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর গ্রীক বৈজ্ঞানিক পাইথাগোরাস মনে করিতেনঃ পৃথিবীই সূর্যকে কেন্দ্র করিয়া ঘুরিতেছে। খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মিসরীয় বৈজ্ঞানিক টলেমী বলিলেনঃ পাইথাগোরাসের মত ভ্রান্ত; সূর্যই পৃথিবীর চারিদিকে আবর্তন করিতেছে। দেড় হাজার বৎসর পর্যন্ত এই মতবাদের প্রাধান্য অব্যাহত থাকে। খৃষ্টান জগত ইহাকে ধর্মমত বলিয়াই মনে করিতে থাকে। ইহার বিরোধীদের ‘ইনকুইজিশন’ আদালতের সম্মুখীন হতে হয়। অতঃপর ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে পোল্যান্ডের থর্ন নিবাসী ডাঃ নিকোলাস কোপারনিকাস (মৃঃ ১৫৪৩ খৃঃ) আসিয়া বলেনঃ পাইথাগোরাস ঠিকই বলিয়াছেন; টলেমীর মতই ভ্রান্ত। এভাবে দূর বা অদূর ভবিষ্যতে অপর কেহ আসিয়া কোপারনিকাসের মতকে যে ভ্রান্ত বলিয়া ঘোষণা করিবেন না, তাহা কি কেহ বলিতে পারে ?
বৈজ্ঞানিক গুরু এরিস্টটল মনে করিতেনঃ গ্রহণের গতিপথ বৃত্তাকার। প্রায় দুই হাজার বৎসর যাবৎ এ মতকে অভ্রান্ত বলিয়া মনে করা এইয়াছে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জন কেপলার (মৃঃ ১৬৩০ খৃঃ) যোষণা করিলেন যে, উহা উপ-বৃত্তাকার।
স্যার আইজাক নিউটন (মৃঃ ১৭২৭ খৃঃ) বলিয়াছিলেনঃ গ্রহগণের এ চক্রাকারে ঘোরার মূলে রহিয়াছে সূর্যের আকর্ষণ। অতঃপর আইনস্টাইন (মৃঃ ১৯৫৫ খৃঃ) আসিয়া বলিলেনঃ ব্যাপার তাহা নহে; গ্রহ-উপগ্রহগুলি নিজেদের সুবিধার জন্যই সূর্যের চারিদিকে ঘুরিতেছে। ইহাই তাহাদের সুবিধার পথ, সূর্যের আকর্ষণে নহে।
পূর্বেকার বৈজ্ঞানিকগণ মনে করিতেনঃ সূর্য স্হির, তাহার কোন গতি নাই। আর আমাদের এ যুগের বৈজ্ঞানিকগণ বলিতে আরম্ভ করিয়াছেনঃ সূর্যের একটা নিজস্ব গতি আছে। গ্রীক বিজ্ঞানী- গণ পানিকে (এভাবে বায়ুকেও) মৌলিত বস্তু মনে করিতেন, অথচ আজ উহা যৌগিক বস্তু প্রতিপন্ন হইয়াছে। বর্তমান বৈজ্ঞানিকদের মতে উহা অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন নামক দুইটি গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত। এভাবে গ্রীক বিজ্ঞানীগণ মৌলিক বস্তুর সংখ্যা মাত্র চারিটি (অব, আতশ,খাক, বাদ) বলিয়াই মনে করতেন, আর আজ উহার সংখ্যা ৯২ পর্যন্ত পোঁছিয়াছে।
এক কথায়, অতীতে যেসকল বৈজ্ঞানিক মতবাদ প্রচারিত হইয়াছে, পরবর্তী পরীক্ষায় সেসকলের অনেকটাই অসত্য বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। ভবিষ্যতেও এরূপই হইতে থাকিবে। এমতাবস্থায় বৈজ্ঞানিক মতবাদের মাপকাঠিতে কুরআন-হাদীসকে বিচার করিতে যাওয়ার মানেই হইল, কুরআন-হাদীসের নিজস্ব কোন সিদ্ধান্ত নাই। বিজ্ঞান যখন যাহা বলে তাহাই কুরআন-হাদীসের সিদ্ধান্ত।
হিজরী দ্বিতীয় তৃতীয় শতাব্দীতে গ্রীক বিজ্ঞানের কোন কোন মতবাদে প্রভাবান্বিত হইয়া মু’তাযিলাগণ কুরআন-হাদীসের কোন কোন
সিদ্ধান্তের অপব্যাখ্যা করিয়াছেন এবং কোন কোন সিদ্ধান্তকে একেবারে অন্ধকারই করিয়াছেন; অথচ যেসকল মতবাদই গলত বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে। তাহারা রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) স্হূলদেহের পক্খে আকাশ ভেদ করা অসম্ভব মনে করিয়া তাঁহার সশরীরে মে’রাজকে অস্বীকার করিয়াছেন। অথচ আজ আকাশ বলিয়াই কোন জিনিসের অস্তিত্ব স্বীকার করা হইতেছে না (ইহাও ভুল) উদ্ভিদের প্রাণ নাই, উহারা নিজেদের স্হান হইতে নড়াচড়া করিতে পারে না মনে করিয়া তাঁহারা কোন কোন হাদীসকে অস্বীকার করিয়াছেন; আর আজ উদ্ভিদরা প্রাণীজগতের সারিতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে; প্রাণীদের ন্যায় উহারা আপন মনে ইচ্ছানুযায়ী নড়াচড়াও করিতে পারে। এভাবে হাওয়ায় তখন উড়ান অসম্ভব মনে করিয়া সন্দিগ্ধচিত্ত লোকগণ হযরত সুলায়মান নবীর তখতে ভ্রমণে বিশ্বাস করিতে ইতস্তত করিয়াছেন; আর আজ আকাশযানে চডিয়া মানুষ চন্দ্রে পৌঁছিবার প্রস্তুতি নিতেছে।
আল্লাহ তা’আলা মানুষকে জ্ঞান ও বুদ্ধি দান করিয়াছেন এবং উহাকে কাজে লাগাইবার জন্যও নির্দেশ দিয়াছেন; তবে উহার জন্য একটা কর্মক্ষেত্রও নির্ধারিত করিয়া নিয়াছেন। তাহা হইল, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় বা বস্তু-জগত। বস্তু জগতের বাহিরে যাহা রহিয়াছে, অর্থাৎ, ‘গায়ব জগত’, যথা-আল্লাহ্ তা’আলার যাত ও সিফাত (সত্তা ও গুণাবলী), ফেরেশতা, জিন, শয়তান, পুলসেরাত, নেকী-বদীর পরিমাপ, বেহেশত, দোযখ, কবর-আযাব প্রভৃতি-তাহা তাহার জ্ঞান ও বুদ্ধির কর্মসীমারই বাহিরে। এসকল বিষয়ে মানুষ কেবল ওহী (তথা কুরআন-হাদীস) দ্বারাই সঠিক সত্য লাভ করিতে পারে। ওহীর সাহায্য ব্যতিরেকে এপথে পা বাড়াইতে গেলেই তাহার পদে পদে পদস্খলন ঘটিতে বাধ্য। এছাড়া বস্তু-জগতেও যে মানুষের সকল গবেষণাই নির্ভুল হইবে তাহা নহে। এখানেও তাহার ভুল করার আশংকা রহিয়াছে এবং করিয়াও আসিতেছে। সুতরাং তাহার গবেষণা-ফলের মাপকাঠিতে কুরআন-হাদীসকে বিচার করিতে যাওয়া ভুল। তবে আমার কথার অর্থ এই নহে যে, বিজ্ঞানের সহিত কুরআন-হাদীসের বৈরীভাবই রহিয়াছে বা কুরআন-হাদীস বিজ্ঞানের কোনই সিদ্ধান্তকে স্বীকার করে না। বিজ্ঞান মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধির দান, আর আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে তাহার জ্ঞান-বুদ্ধি কাজে লাগাইবার জন্য নির্দেশ দিয়াছেন; সুতরাং বিজ্ঞানের সহিত কুরআন-হাদীসের বৈরীভাব বা গরমিল থাকিতেই পারে না। বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক গবেষণা যেখানে সত্যে উপনীত হইবে, সেখানে উহা কুরআন-হাদীসের সহিত নিশ্চয় মিলিয়া যাইবে।
সবাই ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন এবং শামীমব্লগ ডট কম এর সাথেই থাকবেন।